সামাজিক দূরত্বে কষ্ট পাচ্ছেন? প্যারাসিটামল খেয়ে দেখতে পারেন।

হেঁয়ালি করছি না মশাই, সত্যি বলছি। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন আর প্যারাসিটামল-এর জোক না, এক্কেবারে রীতিমতো বিজ্ঞান। আসুন ব্যাপারটা একটু কাল্টিভেট করা যাক।

মানুষ হলো সামাজিক প্রাণী। মানে যে সে সামাজিক প্রাণী নয়, বিবর্তনের ধারায় এক্কেবারে মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে সমাজ। বেশিরভাগ বিজ্ঞানের সাক্ষপ্রমান বলে যে হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকায় আদিম মানুষেরা বিবর্তিত হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট আঁটোসাঁটো দল বেঁধে। এখনো মানুষ সেটাই করে চলছে। ছোট্ট ছোট্ট দলে থাকাতেই আমাদের স্বচ্ছন্দ। এই প্রসঙ্গে একটি জাদু-সংখ্যা হলো নৃতত্ববিদ রবিন ডানবার-এর ১৫০. প্রাচীনকালের শিকাররীর দল থেকে শুরু করে আধুনিকযুগের বিজ্ঞান গবেষণার কোনো বিষয়, সব কিছুই মানুষ মোটামুটি ১৫০ জনের দল-এ করে। হাতি শিকারেও ১৫০ শিকারি, আবার ন্যানোটেকনোলজির সাহায্যে ক্যান্সার সারানোর চেষ্টাতেও হরেকরে সেই ১৫০ বিজ্ঞানী। শুধুই কি সমাপতন? বোধহয় না। এই হাল আমলের ফেসবুক, তাতেও মানুষের বন্ধুসংখ্যার মধ্যমা হলো ২০০, ১৫০-এর খুব দূরে না! ডানবারের ধারণা ছিল যে আমাদের মাথার কর্টেক্স-এর যা আয়তন তাতে তার চেয়ে বেশি বন্ধু ধরে না। শিম্পাঞ্জি বা ডলফিনের বন্ধুর সংখ্যা ঐজন্যই বোধহয় কম। যাইহোক, ১৫০ এক্কেবারে সোনার নিক্তিতে মাপা সংখ্যা না হলেও, মোদ্দা কথা হলো যে মানুষ অনেকজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে সক্ষম, কিন্তু সেই অনেকজনটা হলো মোটামুটি ১৫০-২০০।

তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়ালে আমরা একাকী হয়ে পড়ি। সামাজিক বলয়ে অন্তর্ভুক্তি আমাদের একপ্রকার জৈবিক প্রয়োজন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষকে বিভিন্ন রকমের আত্মহননের পথে ঠেলে দেয়।  জীবনে একা হয়ে পড়ার ভয় আমাদের মজ্জাগত। Jean Twenge ও তার সহকর্মীরা একটি মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় কিছু স্নাতক-স্তর এর ছাত্রছাত্রীকে মিছিমিছি বলেন যে তারা জীবনে একা হয়ে পড়বে এবং অন্য কিছু ছাত্রছাত্রীকে মিছিমিছি বলেন যে তাদের জীবনে সামনে ফাঁড়া আছে। পরে তিনি লক্ষ্য করেন যে যাদের তিনি বলেছিলেন যে জীবনে একা হয়ে পড়বে, তারা আত্মহানিকর বিভিন্ন অভ্যাস বেশি গড়ে তুলছে, যেমন তারা অস্বাস্থকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছে।  অন্যদিকে ফাঁড়ার ভয় কিন্তু কারোর সেরকম নেই! মানে আমরা মরার চেয়েও বেশি ভয় পাই একা হয়ে যাওয়াকে। যাইহোক, পৃথিবীতে সকলকেই কখনো না কখনো একা হতে হয়, কিন্তু আমরা এতই সামাজিক প্রাণী যে তাকে আমরা যমের মতন ভয় পাই।

অনেক তত্ত্বকথা কচলালাম, এবার আসা যাক আসল কোথায়। এই যে একা হওয়ার ব্যাথা, সেটা ঠিক কিরকম ব্যাথা? মানে লকডাউন-এ বেরিয়ে যে কালসিটে-টা পড়ছে, আর বাড়িতে থেকে যে সামাজিক দূরত্বের যে যন্ত্রণাটি আপনি ভোগ করছেন, তাদের কি কোনো সম্পর্ক আছে? আপনি বলবেন, না নেই, কারণ একটি মানসিক ব্যাপার আরেকটি শারীরিক। কিন্ত ধীরে বৎস, ধীরে। এই ঔৎসুক্কের সমাধানে, এক কম্পুটারে কিছু মানুষকে বল ছোড়াছুঁড়ির এক গেম খেলানো হলো, যেখানে তারা জানলো সে অন্য কয়েকটি মানুষের সাথেই গেমটি খেলছে, কিন্তু আদপে উল্টো দিকে আছে কৃত্তিম মেধা। সেই গেম এ ধীরে ধীরে আপনাকে ইচ্ছা করে একপেশে করে আর বল দেওয়া হলো না। সবাই জানলো অন্য খেলোয়ারগুলোও মানুষ, এবং তাকে তারা ইচ্ছা করে বের করে দিলো। আর এই পুরো সময়টায় কিছু মাথার ছবিছৰা তোলা হলো।  বিজ্ঞানীরা দেখালেন, আপনি হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে যেরকম মাথার ক্রিয়াকলাপ হয়, ঠিক সেরকম ছবি! এমনকি আরেকধাপ এগিয়ে, এই একাকিত্বের যন্ত্রনা উপশমে কাজ করলো ব্যাথানিরোধক সবার প্রিয় প্যারাসিটামল! ওরেবাবা মন তো এক্কেবারে মাথায় মশাই।

যাইহোক তাহলে ঘরে বসে বসে কষ্ট পেলে প্যারাসিটামল খেয়ে দেখতে পারেন, কাজ হলেও হতে পারে! আমরা এমনি সামাজিক জীব যে, প্রেমিকা/প্রেমিকের লেঙ্গি থেকে পাড়ার ক্রিকেট দল থেকে ববাদ পড়ার হৃদয় ভাঙ্গা, সবই  আমাদের প্যারাসিটামল খেয়ে সারানোর মতো ব্যাথা দেয়।

References: Psychology: From Inquiry to Understanding; Gladwell, 2005; Dunbar, 1993; Marino, 2005; Eisenberger, 2012; Eisenberger, Lieberman, & Williams, 2003; Twenge, Catanese, & Baumeister, 2002; DeWall et al., 2010.

Leave a comment