দোষ আসলে কার? তোমার না গজার? চীনের না আমেরিকার?

মানুষ মাত্রেই ভুল করে থাকে। আজ আমার সামাজিক মনোবিজ্ঞান নিয়ে লেখা প্রথম ব্লগ প্রবন্ধে সেরকমই এক ভুল নিয়ে কথা বলতে চলেছি যা আমরা প্রতিনিয়ত করে চলি, একপ্রকার না বুঝেই। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। আমি অংকে ১০০ পেলে আমার কৃতিত্ব, আর ৫০ পেলে প্রশ্নপত্র খুব শক্ত ছিল। কিন্তু পাশের বাড়ির গজা যদি ৫০ পায়, গজা উচ্ছন্নে গেছে, আর গজা ১০০ পেলে প্রশ্ন সহজ ছিল। খুব সহজে আমরা আমাদের সাফল্যকে নিজের কৃতিত্ব, আর আমাদের ব্যর্থতাকে পারিপার্শিক পরিবেশ-এর উপর চাপাই; আবার যখন অন্যের সাফল্য বা ব্যর্থতার কথা ওঠে, সাফল্য চলে যায় পারিপার্শিক পরিবেশ-এর উপর আর ব্যর্থতা সেই অন্য জনের ব্যাক্তিত্বে। মনোবিজ্ঞান এর ভাষায় একে বলে আরোপন ত্রূটি বা attribution error।

ধরুন আপনি গ্রামের ছোট্টো মোরাম এর রাস্তা নিয়ে সাইকেল নিয়ে চলেছেন নিজের মতো আস্তে আস্তে, হটাৎ একটা মোটর-বাইকে চড়া হুৱা আপনাকে প্রায় গাড়িচাপা দেওয়ার জোগাড় করে পাস্ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গ্যালো! আপনি কি করবেন? খানিকটা তার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে ছাড়বেন। বাড়ি ঘর-দোর, শিক্ষা, ছোটবেলা, মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ বাকি থাকবে না। কিন্তু আপনি যদি একদিন একইভাবে বাইক-সওয়ারী হয়ে কোনো অভাগা সাইকেল চালক-এর গায়ের উপর দিয়ে চলেযান আপনি কিন্তু বাহ্যিক কারণ খুঁজে নেবেন। হয়তো বাড়িতে কেউ অসুস্থ, হয়তো আপনার উর্ধতন আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে রেখেছে, বা  নিদেনপক্ষে আপনার আজ মজা করতে ইচ্ছা করছে ওরকম করে। কক্ষনো কিন্তু আপনি ভাববেন না, আপনার ছোটবেলায় কে কি শেখায়নি! তো আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো নিজেদের ত্রূটিপূর্ণ কাজের জন্য দায়ী করা বাহ্যিক কারণকে আর অন্যের সেরকম কাজের জন্য দায়ী করা তাদের স্বভাব-চরিত্র কে।

আরেকটা উদাহরণ দেখা যাক। ভারত পাকিস্তান-এর ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। এখনকার মতো একপেশে নয়, সচিন-এর আমল এর টানটান উত্তেজনার ম্যাচ।  আখতার-এর একটা বল দুম করে পিচ এর গর্তে পরে ইনসুইং করে এক্কেবারে সচিন-এর স্ট্যাম্প-এ! আপনি তো রে রে করে উঠে পিচ কিউরেটর এর মা বাবা টেনে নিয়ে এলেন! এবার পাকিস্তান নেমেছে ব্যাট করতে। কুম্বলের একটা বল দুম করে সেই গর্তে পরেই ৭০ ডিগ্রি ঘুরে আনোয়ার এর বেল উড়িয়ে দিলো! আপনি কি বলবেন? বলবেন গরুখেকো আনোয়ার আবার ব্যাট করতে এসেছে! কুম্বলের সামনে ওসব ২-টাকার ব্যাটসম্যান কি দাঁড়াতে পারে! বুঝলেন আপনি ঠিক কি করলেন? আপনি নিজের দলের লোকের ভুল এর কারণ হিসেবে দেখলেন একটা বাহ্যিক কারণ, সচিন খেলতে পারেনি নয়, বলটা  অকারণ এ ঘুরে গিয়েছে। আর অন্য দলের আনোয়ার ক্যানো আউট হয়ে গ্যালো? সে খারাপ খেলে আউট হয়ে গ্যালো! এবার প্রশ্ন হলো, এই যে দিন দুবেলা আমরা মনের আদালত খুলে সবার বিচার করে চলেছি, তাতে ‘ত্রূটি’ তা কোথায়? এটা তো সাধারণ পক্ষপাতিত্ব হতে পারে, এক্কেবারে ত্রূটি বলে বাড়াবাড়ি হয়ে গ্যালো না?

আচ্ছা আপনার কাছে কার পারিপার্শিক অবস্থা এবং স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সবথেকে বেশি তথ্য রয়েছে? কার সবটা আপনার কাছে জানা? আপনার নিজের! আপনি আপনার নিজের যখন সবটা জেনে রায় দিচ্ছেন তখন বেশিরভাগ সময়ই আপনি বলছেন আপনি খারাপ মানুষ নন, আপনার পারিপার্শিক পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করেছে ওরকম ব্যবহার করতে। সবটা জেনে আপনার নিজের উপর দেওয়া রায় তাহলে সবচেয়ে নিখুঁত। এবার যখন সেই  আপনি অন্য কারোর বিচার করেছেন, তখন বেশিরভাগ সময় অন্যের চরিত্রে কালিমালেপন করছেন, তাদের পারিপার্শিক অবস্থার কথা না ভেবেই। তাহলে আপনি নিজের বিচার ঠিক করছেন, কিন্তু অন্যের বিচার করতে গিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ সত্তা বা চরিত্রের উপর একটু বেশি চাপিয়ে দিচ্ছেন। ব্যাস এইখানেই ত্রূটি।

এবার কথা হলো, ত্রূটি হচ্চে তো বুঝলেন, কাটাবেন কিকরে এই ত্রূটি? খুব সোজা। শুধু এই বিষয়ে বোধোদয় হলেই হবে! এরপরে কারোর মা-বোন ডেকে আনার আগে একবার ভাববেন যে মানুষ-এর আরোপন ত্রূটি হয়। ব্যাস, তাহলেই আস্তে আস্তে জগৎকে অন্য চোখ-এ দেখতে শুরু করবেন। কারোর ঝটিকা-বিচার করার আগে একটু ভাবুন, জানুন কোন পরিস্থিতিতে সে রয়েছে, সময় দিন, তার জুতোয় পা-গলিয়ে কয়েক পা হেঁটে দেখুন। দেখেবন সেও মানুষ আপনিও মানুষ; দেখবেন চীন ও দেশ, ভারত ও দেশ, এমনকি আমেরিকা ও; তফাৎ শুধু attribution error বা আরোপন ত্রূটি- তে।

Reference:

https://en.wikipedia.org/wiki/Fundamental_attribution_error

https://en.wikipedia.org/wiki/Ultimate_attribution_error

Leave a comment